কামিল পীর বনাম ভন্ড পীর
কামিল পীর বনাম ভন্ড পীর
সুপ্রিয় সুধী সোসেল মিডিয়ার উপর কিছু ছবি ঘুরছে, যাতে দেখা যায় কিছু বদমাশ ধরনের পীর যারা বাহ্যিকভাবে জুব্বা পাগড়ি মুখে দাড়ি ও মাথায় টুপি পরিধান করে আছে, তারা নারীদের জড়িয়ে ধরছে, আবার সেগুলি ভিডিও করে প্রচারও করছে, নাউজুবিল্লাহ। যে কাজ রসুলের শরীয়তের খেলাফ তা কিভাবে একজন পীর করতে পারে? আমাদের আঁকা মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (দঃ) এর সাথে একজন মহিলা সাহাবি মুসাফাহা করতে চাইলে হুযুর (দঃ) ফরমালেন (লা উছাফিহুন নিছা) আমি নারীদের সাথে মুসাফাহা করি না। এসব ভন্ড পিরের বলে এরা আমার মুরিদ আমার মেয়ের মত। এসবই ভন্ডামি মেয়ের মত হতে পারে কিন্তু মেয়েত নয়। এটা শরীয়তে ইসলামীয়ার মাসায়ালা। হযরত সাইদ ইবনে মুসাইয়্যাব জলিলুল কাদার তাবিয়ি যিনি অন্ধ ছিলেন, বয়স উনার ৮০ বছর জীবন মরনের মাঝামাঝি সময় উনার চলছিল। উনার কাছে যখন কেহ উনার শারীরীক অবস্থা জিজ্ঞাস করল তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহর শোকর, শয়তান যে কোন রুপে আমার কাছে আসুক না কেন আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না, কিন্তু যদি শয়তানে কোন নারীর সুরত নিয়ে আসে তাহলে তা আমার জন্য বড়ই ভয়ের কারন হবে। এ কথা কে বলছে? যার বয়স ৮০ বছর , এ কথা কে বলছে যিনি অন্ধ, এ কথা কে বলছে যিনি জীবন মরনের মাঝামাঝি সময় অতিবাহিত করছেন। এ কথা কে বলছে যিনি রসুলের তাবেয়ি।
আর এখন এসব ভন্ড পিরের শারিরিকভাবে এখনও শক্তিশালি নারীদের মাঝে বসে বসে পীর গিরি করছে, এ সবই হল ভন্ডামি। যাদের ধর্মীয় জ্ঞান নাই অসংখ্য এমন মুর্খরা মুলত পীর মানার মন মানসিকতায় কিছু শরীয়তের দুশমনকে পীর হিসেবে গ্রহণ করে নিচ্ছে। যে কেউ নিজেকে পীর দাবী করছে তাকেই তারা মেনে নিচ্ছে, চাই সে ইসলামের শত্রু হউক, চাই ভন্ডামি করে পরনের কাপড় ছুরে ফেলুক, নাউজুবিল্লাহ।
একটা কথা মনে রাখবেন যে জিনিস ভাল চলে সে জিনিসের নকলও বেশী হয়, শরীয়ত যারা প্রকৃত আল্লাহর অলি তাদের ছোহবত এখতেয়ার করার জন্য বলেছে, আর সেটিকে নকল করে কিছু মুখোশধারী ভন্ড জুব্বা গায়ে দিয়ে মাথায় লম্বা চুল রেখে মানুষকে ধোকা দিতে নিজেকে পীর বলে দাবী করে। আর বাহ্যিক জুব্বা দেখে আমাদের মুসলমানরা ধোকা খেয়ে যায়। আর এসব ধান্দাবাজ নকল মুখোশধারী ভন্ড পিরের খপ্পরে পরে সরলপ্রাণ মুসলমানরা নিজের ঈমান ও আমল উভয়ই বরবাদ করছে। সুতরাং এক দল হল যা আসলকে তালাশ করতে গিয়ে নকল পীরের দ্বারা ধোকা খেয়ে ফেলে।
আবার আরেকটি দল হল যারা নকল পীরের কাছ থেকে ধোকা খেয়ে- আসল কিংবা প্রকৃত আল্লাহর ওলি যারা, হক্কানি পীর যারা, শরীয়তের পাবন্দ আল্লাহ ওয়ালা যারা, যাদের দেখলে আল্লাহর কথা মনে আসে, যাদের ছোহবতে থাকলে গুনাহ ছেড়ে দিতে কষ্ট হয় না, যাদের সংস্পশে থাকলে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পথ অনুসরণ সহজ হয় এমন ধরনের হক্কানি পীরকেও অস্বিকার করে বসে। সুতরাং যে নকল পীরের কারনে আসল পীরকেও অস্বিকার করে বসল সেও বঞ্চিত হয়ে গেল।
তাই আমাদের উচিত আগে আসল ও নকল পীর চিহ্নিত করা। যারা প্রকৃত আল্লাহ অলি তাঁদের প্রতি মহব্বত ভালবাসা আমাদের অন্তরে জাগরুক কারন আমাদের এ উপমহাদেশে কোন নবী আসেন নি এসেছেন প্রিয় নবীর নায়েবে রসুলগন, আমরা যদি আমাদের নসবনামা পাঠ করি তাহলে দেখা যাবে আমাদের পূর্বপুরুষ হয়ত হিন্দু কিংবা কোন শিখ বা কোন বৌদ্ধ, আজ আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শোকর আমরা মুসলমান কারন এ উপমহাদেশে যারা ইসলামের প্রচার করেছেন এটা তাদের সদকা, এটা সদকা হল হযরত মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ) এর, এটা সদকা হল হযরত দাতা গনজেবখশ (রহঃ) এর, এটা সদকা হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর, এটা সদকা হযরত মুজাদ্দেদে আলফে সানি (রহঃ) এর। সুতরাং আমাদের পূর্বপুরুষগন যে ইসলাম পেয়েছেন তা এসব বুযুর্গগনের সদকায় হাছিল হয়েছে। তাই যদি কোন ওয়াফাদার মুসলমান হয়ে থাকে তাহলে সে কখনো এসব বুযুর্গদের অস্বিকার করতে পারে না। কিন্তু খুবই দুঃখ জনক হলেও সত্য আজ মিডিয়ার মাধ্যমে কিছু ফেইক পীর ভন্ডপীরের আচার আচরন কাজ কারবার দেখে দুই নম্বর নকল পীরের কান্ড কারখানা দেখে অনেকে মনে করে থাকেন যেন হয়ত পুরানা বুযুর্গরাও এমনই ছিল, নাউজুবিল্লাহ। আর এসব ভন্ডদের উপর কেয়াস করে আল্লাহর প্রকৃত ওলিদের প্রতি বিদ্রুপাত্মক উক্তি ছুরে মারে।
মোটকথা আমাদেরকে ভন্ডপীরদের এসব ভন্ডামিও বন্ধ করতে হবে, সাথে সাথে প্রকৃত আল্লাহ ওয়ালা পীর বুযুর্গদের সম্মান জানাতে হবে।
মনে রাখবেন যিনি কামিল পীর বা ওলি হবেন তিনি সহিহ আকিদা বিশিষ্ট হবেন, দ্বিতীয়ত শরীয়তের পাবন্দ হবেন উনার বাহ্যিক চাল চলন সম্পূর্ণ সুন্নতের মোতাবেক হবে, তৃতীয়ত কামিল পীর প্রকৃত আলিম হবেন, দ্বীনের পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হবেন। চতুর্থত কিতাবসমুহ থেকে কারো সাহায্য ছাড়া কোন মাসায়ালা নিজে নিজে বের করতে পারবেন। পঞ্চমত প্রকাশ্য কোন গুনাহ করবে না। ষষ্ঠত- দুনিয়ার কোন ধরনের লোভ লালসার অধিকারী হবেন না। সপ্তমত- প্রকৃত কামিল পীর তার মুরিদানদের আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পথে চলতে উৎসাহিত করবেন আল্লাহর রসুল ও আল্লাহ রব্বুল আলামিনের নৈকট্য হাসিলে পথনির্দেশনা দিবেন।
পক্ষান্তরে যাদের আকিদা শুদ্ধ নয়, যারা আলেম নন ও যাদের ধর্মিয় জ্ঞানের অভাব, যাদের চাল-চলন সম্পূর্ণ শরীয়তের উপর নয়, যারা প্রকাশ্য গুনাহে লিপ্ত, যাদের কাজ কারবার সুন্নতের বিপরীত, যারা মুরিদের সম্পদের লোভি যারা দুনিয়ার লালসায় পীর সাজে এদের থেকে ১০০ মাইল দুরে থাকুন।
আল্লাহ তায়ালা সুরা ইউনুসের ৬২-৬৪ নং আয়াতে আল্লাহর ওলিদের পরিচয় দিয়ে এরশাদ করেন। ‘জেনে রেখ! আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। যারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়া ও আখেরাতে, আল্লাহর বাণীর কোনো পরিবর্তন নেই; এটিই মহাসাফল্য।’
আয়াতের ভাষা হলো, ‘আউলিয়া আল্লাহর’ একবচন হল ওলি। ওলি ফাঈলুনের ওজনে ফায়েল বা কর্তৃকারকের অতিশয়বাচক মুবালিগা। এই অর্থে ওলি বলা হয় এমন ব্যক্তিকে যার ইবাদত ও আনুগত্য এমন লাগাতার যে, কোনোরূপ নাফরমানি তাতে বিঘ্ন বা ব্যত্যয় সৃষ্টি করে না।
নবীরা মাসুম তবে ওলিদের দ্বারা ছোটখাটো পদস্খলন হতে পারে। তবে তিনি সেই পদস্খলনের পুনরাবৃত্তি করেন না। কোরআন মজিদের ভাষায় ‘এরাই হলো সেই লোক যারা অবিলম্বে তওবা করে নেয়।’ ‘আল্লাহ অবশ্যই সেসব লোকের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে এবং সত্বর তওবা করে, এরাই তারা যাদের তওবা আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা নিসা : ১৭)।
হজরত সাঈদ ইবনে জুবায়র (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়, কারা আল্লাহর ওলি। নবীজি বলেন, তারা সেই লোক যাদের দেখলেই আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। নবী করিম (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার ওলি তারা, যারা আমার স্মরণ নিয়ে আলোচনা করে আর আমি তাদের কথা স্মরণ করে আলোচনা করি। (মুসনদে আহমদ : ২২৭)।
হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন লোকেরা রয়েছেন, যারা নবী নন, শহীদও নন। কিন্তু আল্লাহর দরবারে তাদের পদমর্যাদা দেখে নবী ও শহীদরা ঈর্ষান্বিত হবেন। লোকদের মধ্যে একজন বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! তারা কারা? এবং তাদের কাজকর্ম কীরূপ? হয়তো আমরা তাদের পরিচয় পেয়ে তাদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করব। নবীজি বললেন, তারা সেই লোক, যারা পরস্পরের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন না থাকা বা একে অপরের মধ্যে কোনোরূপ লেনদেন বা টাকাপয়সার স্বার্থ না থাকা সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে পরস্পরকে ভালোবাসে। আল্লাহর কসম, তাদের মুখম-ল হবে নূরে আলোকিত। আর তারা অবস্থান করবে নূরের মিম্বরের ওপর। মানুষ যখন ভীতসন্ত্রস্ত হবে তখন তারা ভীত হবে না। মানুষ যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে তখন তারা চিন্তান্বিত হবে না। অতঃপর নবীজি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করেন ‘জেনে রেখো! আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’ (মুসনদে আহমদ : ৫/৩৪১)।
আল্লাহ আমাদেরকে ভন্ড পীর থেকে বেঁচে থেকে আল্লাহর প্রকৃত ওলীদের ভালবাসার এবং কামিল ওলি আল্লাহর ছোহবত এখতেয়ার করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
কোন মন্তব্য নেই